প্রবাহ ডেস্ক :
আমার ছোটবেলার সব জন্মদিনই ছিল স্মরণীয়। জন্মদিন আসার আগেই মনের ভেতর এক ধরনের উৎসাহ কাজ করত, কী করব না করব। আমার মা আমার জন্য নতুন জামা সেলাই করে রাখতেন। আমার বড় বোন দীনা লায়লাও আমার জন্য জামা সেলাই করতেন।
নতুন জামা, নতুন জুতা, চুলের ফিতা এসবই চাইতাম জন্মদিনে। বন্ধুরা বিভিন্ন মোড়ক নিয়ে আসত, কেক কাটা হতো, সব মিলিয়ে খুব আনন্দ হতো।’ নিজের জন্মদিন নিয়ে এভাবেই বললেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা।
আজ (১৭ নভেম্বর) কিংবদন্তি এই গায়িকার ৭২তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৫২ সালের এই দিনে রুনা লায়লা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সিলেটে জন্মগ্রহন করেন। পরিবারের সদস্য ও একান্ত প্রিয় কয়েক জনের সঙ্গে দিনটি উদযাপন করবেন তিনি।
তার বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলী ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা আনিতা সেন ওরফে আমেনা লায়লা ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী। তার মামা সুবীর সেন ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। তার যখন আড়াই বছর বয়স তার বাবা রাজশাহী থেকে বদলী হয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতানে যান।
সেই সূত্রে তার শৈশব কাটে পাকিস্তানের লাহোরে। তারা দুই বোন এক ভাই। বোন দীনা লায়লা এবং ভাই সৈয়দ আলী মুরাদ। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে দীক্ষা নিয়েছেন ওস্তাদ হাবিব উদ্দিন খান ও আবদুল কাদের পিয়ারাংয়ের কাছে। গজলে দীক্ষা নিয়েছেন পণ্ডিত গোলাম কাদিরের (মেহেদী হাসানের ভাই) কাছে।
ছোটবেলা থেকেই গান করেন তিনি। মাত্র ছয় বছর বয়সে দর্শকের সামনে প্রথম গান গেয়ে মাত করেন রুনা লায়লা। মাত্র সাড়ে এগারো বছর বয়সে শুরু হয় সিনেমায় প্লেব্যাক। করাচিতে জুগনু চলচ্চিত্রে প্রথম গান করার মধ্য দিয়ে সিনেমার গানে তার যাত্রা শুরু।
তবে বাংলাদেশে রুনা লায়লা প্রথম প্লেব্যাক ১৯৭০ সালে নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘স্বরলিপি’ চলচ্চিত্রে। সুবল দাসের সুর ও সঙ্গীতে এই সিনেমার ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে বলো কী হবে’ গানটিতে কণ্ঠ দেন।
তার মানে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই তিনি চলচ্চিত্রের গায়িকা হিসাবে কাজ শুরু করেন। দেশে আসার পর ১৯৭৬-এ প্রথম প্লেব্যাক করেন নূরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘জীবন সাথী’ চলচ্চিত্রে। এর সুর ও সঙ্গীত করেছিলেন সত্য সাহা। রুনা লায়লার সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছিলেন খন্দকার ফারুক আহমেদ।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় এবং পাকিস্তানী চলচ্চিত্রের অনেক গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। পাকিস্তানে তার গাওয়া ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’ গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।
১৯৬৬ সালে লায়লা উর্দু ভাষার হাম দোনো চলচ্চিত্রে ‘উনকি নাজরোঁ সে মোহাব্বত কা জো পয়গম মিলা’ গান দিয়ে সঙ্গীতাঙ্গনে আলোচনায় আসেন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি পাকিস্তান টেলিভিশনে নিয়মিত গান করতে থাকেন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালে তিনি জিয়া মহিউদ্দিন শো-তে গান পরিবেশন করতেন এবং ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেওয়া শুরু করেন।
১৯৭৪ সালে তিনি কলকাতায় ‘সাধের লাউ’ গানের রেকর্ড করেন। একই বছর মুম্বাইয়ে তিনি প্রথমবারের মতো কনসার্টে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ সময়ে দিল্লিতে তার পরিচালক জয় দেবের সাথে পরিচয় হয়, যিনি তাকে বলিউড চলচ্চিত্রে এবং দূরদর্শনের উদ্বোধনী আয়োজনে গান পরিবেশনের সুযোগ করে দেন।
এরই মধ্যে রুনা লায়লা এক জন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও নিজের অভিষেক ঘটিয়েছেন। নায়ক, প্রযোজক, পরিচালক আলমগীর পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’তে রুনা লায়লার সুরে আঁখি আলমগীর একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত রুনা লায়লা চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার কারণে পেয়েছেন ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
১৯৭৭ সালে আব্দুল লতিফ বাচ্চু পরিচালিত ‘যাদুর বাঁশি’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করার জন্য প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। এর পর তিনি একই সম্মাননায় ভূষিত হন ‘এ্যাকসিডেন্ট’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘তুমি আসবে বলে’, ‘দেবদাস’, ‘প্রিয়া তুমি সুখী হও’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক’র জন্য।
দেবু ভট্টাচার্যের সুরে প্রথম করাচি রেডিওতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রথম রুনা লায়লার কণ্ঠে বাংলা গান শোনা যায়। ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’, ‘আমি নদীর মতো কতো পথ পেরিয়ে’ গান তার কণ্ঠে শোনা যায়।
‘এক সে বাড়কার এক’ চলচ্চিত্রের শীর্ষ গানের মাধ্যমে তিনি সঙ্গীত পরিচালক কল্যাণজি-আনন্দজির সাথে প্রথম কাজ করেন। এই গানের রেকর্ডিংয়ের সময় প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর তাকে আশীর্বাদ করেন। তিনি ‘ও মেরা বাবু চেল চাবিলা’ ও ‘দামা দম মাস্ত কালান্দার’ গান দিয়ে ভারত জুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শিল্পী’ নামক চলচ্চিত্রে চিত্রনায়ক আলমগীরের বিপরীতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুনা লায়লা। ‘শিল্পী’ চলচ্চিত্রটি ইংরেজি চলচ্চিত্র ‘দ্য বডিগার্ড’-এর ছায়া অবলম্বনে চিত্রিত হয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবনে রুনা লায়লা তিনবার বিয়ে করেন। প্রথম বার তিনি খাজা জাভেদ কায়সারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দ্বিতীয় বার তিনি সুইস নাগরিক রন ড্যানিয়েলকে বিয়ে করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি বাংলাদেশী অভিনেতা আলমগীরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার একমাত্র কন্যা তানি লায়লা।
বাংলাদেশের সঙ্গীতের কিংবদন্তি এই শিল্পী চলচ্চিত্র, পপ ও আধুনিক সঙ্গীতের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশের বাইরে গজল শিল্পী হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে তার বেশ সুনাম রয়েছে। পাঁচ দশকের দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে ১৭ ভাষায় ১০ হাজারেরও বেশি গান করেছেন রুনা লায়লা।
অর্জন করেছেন উপমহাদেশের কোটি মানুষের ভালোবাসা। বাংলা ছাড়া রুনা লায়লা উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা জানেন। তবে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষায় গান করেছেন তিনি।
বাংলা, উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, বালুচ, ফারসি, আরবি, স্প্যানিশ, ফরাসি কিংবা ইংরেজি, এমন অনেক ভাষার গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। সুরকার নিসার বাজমির ১০টি করে তিন দিনে মোট ৩০টি গান রেকর্ডের পর রুনা লায়লা নাম লেখান গিনেস বুকে।
তিনি ১৮টি ভাষায় গান গাওয়া, নিজের সঙ্গীত জীবন নিয়ে নির্মিত ‘শিল্পী’ সিনেমায় অভিনয় করা-সব মিলিয়ে রুনা লায়লা উপমহাদেশের এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
বাংলা গানের অমূল্য রত্ন রুনা লায়লার কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি’, ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে’, ‘যখন থামবে কোলাহল’, ‘শিল্পী আমি তোমাদেরই’, ‘সাধের লাউ বানাইলো’, ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর’, ‘জীবনো আঁধারে পেয়েছি’, ‘পান খাইয়া ঠোঁট’ এবং ‘বাড়ির মানুষ কয় আমায়’।
কিংবদন্তি এই কণ্ঠশিল্পীর জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা। বরেণ্য এই শিল্পী তার জাদুময়ী সুরের মায়ায় আরও বহুদিন আমাদের সঙ্গীতকে আলোকিত করুক এই প্রত্যাশা নিরন্তর। তার জন্য শুভকামনা।